Published Date : 19-05-29
536 Views
- ইংরেজী ‘Civilization’-এর বাংলা অর্থ করা হয়েছে সভ্যতা। সমাজবিকাশের পদ্ধতি বা পর্যায় বিশেষ অনুসারে ইংরেজী ‘Civilize’ শব্দটির অর্থ হল আদিম বা অজ্ঞ অবস্থা থেকে উন্নতর অবস্থায় তুলে আনা সভ্য করা, উন্নত ও শিক্ষত করা বুঝায়। ‘Civilize’ শব্দটিকে তে এভাবে বলা হয়েছে যে, অর্থাৎ “বর্বর অবস্থা হতে উদ্ধার, জীবনযাত্রার কলা-কৌশল শিক্ষা; মানুষকে জ্ঞানে আলোকিত ও তরা রুচি মার্জিত করা”।
- ‘ সভ্যতা’ শব্দের ইংরেজী প্রতিশব্দ Civilization যা ল্যাটিন শব্দ ‘Civilis’ থেকে এসেছে। ‘Civilis’ এর অর্থ হল নাগরিক।
- সভ্যতার সংজ্ঞা- মানুষ তার সৃজনশীল প্রয়াস দ্বারা এবং বিজ্ঞানের আশীর্বাদপুষ্ঠ হয়ে যে সামগ্রিক সমাজ জীবন গড়ে তুলে তার বাহ্যিক বস্তুগত প্রতিফলন হল সভ্যতা।
- জিসর্বাটের মতে, “সভ্যতা হচ্ছে সাংস্কৃতিক জীবনের একটি পরিনত স্তর”। এল, এইচ মর্গান তার “ Ancient Society” গ্রন্থে বলেন, “সভ্যতা হচ্ছে কুসংস্কারবর্জিত সমাজের চূড়ান্ত রূপ”।
- প্রধান প্রধান সভ্যতা:-মেহেরগড় সভ্যতা , সিন্ধু সভ্যতা , আর্য সভ্যতা।
মেহেরগড় সভ্যতা:
- মেহেরগড় সভ্যতা হল নিওলিথিক সভ্যতা।
- মেহেরগড় সভ্যতা হল ভারতের প্রাচীনতম সভ্যতা।
- মেহেরগড় সভ্যতার আবিস্কার (১৯৭৪-১৯৮৬) ফরাসী প্রত্নতত্ববিদ জা ফ্রাঁসোয়া জারিজ ও রিচার্ড মিডো আবিস্কার করেন।
- পাকিস্তানের অন্তর্গত বেলুচিস্তানের বোলার নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে মেহেরগড় সভ্যতার আবিস্কার করা হয়েছিল।
- কয়েকটি এলাকা বা অঞ্চল জুড়ে শিকারি ও পশুপালনের অস্থায়ী আবাসস্থল ছিল বলে জানা গিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে এলাকা গুলিতে কৃষি ভিত্তিক জীবনচর্চার এক উপযুক্ত ভূমিতে পরিনত হয়েছিল।
- বাসস্থানগুলি কাদামাটি ও রোদে শুকানো ইটের তৈরি ছিল। বাড়িগুলি বিভিন্ন ছোটো ছোটো কামায় বিভক্ত করা হয়েছিল।
- বাড়িগুলিতে মানুষেরা শীতের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আগুন জ্বালানোর ব্যাবস্থা করা হয়েছিল।
- অনেক বাড়িতে শশ্যাগার হিসেবে একটি কক্ষ ব্যাবহার করা হয়।
- এখানে বিভিন্ন ধরনে পাথরের হাতিহারের ব্যাবহার কথা জানা যায়।
- বসবাসকারীদের কিছু উল্লেখ্যযোগ্য গৃহ পালিত পশুগুলি হল গরু, ভেড়া , ছাগল, প্রভৃতি।
- সর্বপ্রথম কুকুর নামক প্রাণীটি মানুষের কাছে পোষ মেনেছিল।
- এই সভ্যতার মানুষদের দ্বারা উৎপাদিত ফসলগুলি হল গম , জব , বার্লি প্রভৃতি চাষ করা হত।
- এখানে কার্পাসে চাষ করা হয় বলে মনে করা হয়েছিল।
- সেচ ব্যাবস্থার প্রমান পাওয়া গিয়েছে বলে জানা যায়।
- মৃৎশিল্পের প্রমান পাওয়া যায়।
- এই সভ্যতার বিভিন্ন প্রকার বানিজ্যের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছে বলে পণ্ডিতদের অনুমান।
- নানা প্রকার জামিত্যিক নশকা , পশু-পাখি , গাছপালার ছবির ব্যাবহার প্রচলন ছিল।
- এই সভ্যতার মানুষেরা পাথর কেটে বিভিন্ন প্রকারের অলংকার তৈরিতে দক্ষ ছিল।
- বহির্বাণিজ্যর বিস্তার ঘটে ছিল। বিভিন্ন প্রকার সাহসী নারীদের মূর্তির সন্ধান পাওয়া যায়।
সিন্ধু সভ্যতা / হরপ্পা সভ্যতা:
- ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তাম্র-প্রস্তর যুগের সভ্যতার সবচেয়ে উন্নত নিদর্শন আবিষ্কার করেন।
- তিনি জন মার্শালের তত্ত্বাবধানেসিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় মহেন-জো-দরোতে মাটি খুঁড়ে ভারতীয় সভ্যতার উন্মেষকে কয়েক হাজার বছর পিছিয়ে দেন।
- সম্ভবত ভারতীয়রাই এই সভ্যতার জন্ম দিয়েছিল । এই প্রাচীন সভ্যতার সময়সীমা সম্ভবত খ্রিস্টপূব ২৫০০ অব্দ থেকে ১৫০০ অব্দ পর্য়ন্ত স্থায়ী ছিল।
- উন্নত মানের নগর পরিকল্পনা ও গৃহনির্মাণশৈলী । নগরগুলির মধ্যে হরপ্পা ও মহেন-জো-দরো উল্লেখযোগ্য । নগরগুলির পরিকল্পনা ছিল প্রায় একই ধরনের।
- নগরগুলি দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল- দূর্গ ও সাধারণ মানুষের জন্য নীচের শহরাঞ্চল।
- দূর্গগুলি ইটের তৈরি, উঁচু চাতালের উপর অবস্থিত এবং মূল শহর থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল।
- শহরে বন্যা হলেও দূর্গে জল ঢুকত না। শাসকশ্রেণি এখানেই বাস করত । মহেন-জো-দরোতে একটি বিশাল স্নানাগার আবিষ্কৃত হয়েছে।
- সিন্ধু সভ্যতা নগরকেন্দ্রিক হলেও অধিকাংশ মানুষ গ্রামে থাকত । কৃষিই ছিল প্রধান জীবিকা। গম, জব, সরিষা, তিল প্রভৃতি ছিল প্রধান শস্য।
- সিন্ধুনদের বন্যার জল জমিকে উর্বর করত।
- কৃষিকার্যের পাশাপাশি সিন্ধুজনগণ পশুপালন করত। মেষ, গোরু, ছাগল, কুকুর ছিল প্রধান গৃহ পালিত পশু।
- অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক বাণিজ্য ছিল তাদের উপজীবিকা। মাল পরিবহণের জন্য দু-চাকার গাড়ির ব্যবস্থা ছিল। স্থল ও জল উভয় পথেই ব্যবসা চলত । লোথালে একটি পোতাশ্রয় ছিল।
- তামা, ময়ূর, হাতির দাঁত, চিরুনি, বস্ত্র প্রভৃতি ছিল প্রধান রপ্তানি দ্রব্য।
- আমদানি হত রুপো ও অন্যান্য ধাতু। সিলমোহর গুলি সম্ভবত বাণিজ্যের কাজে ব্যবহৃত হত।
- অনেক মানুষ মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প ও অলঙ্কার শিল্পেও নিযুক্ত ছিল। সোনা ও রুপো উভয় প্রকারের অলংকারেরই প্রচলন ছিল।
- কৃষিকার্যের পাশাপাশি সিন্ধুজনগণ পশুপালন করত। মেষ, গোরু, ছাগল, কুকুর ছিল প্রধান গৃহ পালিত পশু।
- শহরের জনগণের একটা বড় অংশ ছিল শিল্পী ও কারিগর । বস্ত্রবয়ন শিল্প ছিল খুবই উন্নত। তাছাড়া অনেক মানুষ মৃৎশিল্প, ধাতুশিল্প ও অলঙ্কার শিল্পেও নিযুক্ত ছিল সোনা ও রুপো উভয় প্রকারের অলংকারেরই প্রচলন ছিল।
- তাছাড়া কাস্তে, কুঠার, বর্শা, ছুঁচ, ইত্যাদিও তৈরি হত।এই সব দ্রব্য তৈরি করতে তামা ও ব্রোঞ্জ ব্যবহৃত হত । লোহার ব্যবহার সিন্ধু জনগণ জানত না। তবে সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্বে লোথালে লোহার ব্যবহারের কিছু নিদর্শন পাওয়া গেছে।
- সিন্ধু সমাজে ধনবৈষম্য ও শ্রেণিবৈষম্য প্রকট ছিল।
- সিন্ধু সমাজ বিভিন্ন গোষ্টীতে বিভক্ত ছিল, যথা পুরোহিত সম্প্রদায়, বণিক, কৃষক, দক্ষকারিগর এবং শ্রমিক।
- তাদের প্রধান খাদ্য ছিল গম, যব, তরি-তরকারি ও খেজুর তা ছাড়া তাদের খাদ্য তালিকায় মাছ, মাংস ও ডিমও অন্তর্ভুক্ত ছিল । সুতিবস্ত্র ছিল তাদের প্রধান পোশাক। শীতের দিনে তারা পশমের পোশাক পরত । নারী-পুরুষ উভয়েই অলংকার পরত । সিন্ধু জনগণ যেসব জিনিস ব্যবহার করত, তার মধ্যে মাটির তৈরি নানা বাসন, যেমন- থালা, জালা, কলসি, বাটি ইত্যাদি।
- এ ছাড়া তামা, রুপো, ব্রোঞ্জ ও চিনামাটির তৈরি জিনিসপত্রও পাওয়া গেছে । ছুরি, হাতির দাঁত অথবা হাড়ের তৈরি চিরুনি, কাস্তে, কুড়ুল, চারচৌকো পাথর (ওজনের মাপ) ইত্যাদিও ব্যবহৃত হত।
- সিন্ধুজনগণের মধ্যে মাতৃপূজার প্রচলন ছিল।
- তা ছাড়া যোগাসনে ধ্যানমগ্ন পশুপরিবেষ্টিত তিনমুখবিশিষ্ট একটি পুরুষ দেবমূর্তিও পাওয়া গেছে । এই মুর্তির সঙ্গে শিবের সাদৃশ্য আছে, তাই মার্টিমার হুইলার এই দেবতাকে শিবের পূর্ব সংস্করণ বলে মনে করেন।
- কয়েকটি শিব লিঙ্গের আবিষ্কার এই অনুমানকে জোরদার করে মূর্তিপূজা ছাড়া শক্তির আরাধ্যরূপে পাথর, গাছ ও জীবজন্তুর পূজাও প্রচলিত ছিল।
আর্য সভ্যতা:
- সিন্ধু-সভ্যতা পতনের পর ধীরে ধীরে যে জাতিটি ভারতের ইতিহাসে প্রবেশ করে এরাই ‘আর্য’ নামে পরিচিত।
- আনুমানিক ১০০০-৫০০ খ্রিস্ট পূর্বাব্দ পর্যন্ত।
- আর্য কথার অর্থ হল অভিজাত ও জ্ঞানী মানুষ।
- বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রের উদ্ভব হয়েছিল।
- সামাজিক জীবনে চতুরাশ্রম বিদ্যমান ছিল। এছাড়া সগোত্র বিবাহ নিষিদ্ধ করে অনুলোম ও প্রতিলোম বিবাহের আইন কিংবা বন্দোবস্ত চালু করা হয়েছিল।
- আর্যদের ভাষা হল সংস্কৃত।
- বৈদিক সভ্যতার মুদ্রাগুলি হল মনা ও নিস্ক।
- বৈদিক সভ্যতার উল্লেখ্যযোগ্য সাহসী নারীর নাম হল অপলা, ঘোষা,বিশ্ববারা, লোপামুদ্রা।
- আর্যদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বা সংস্কৃতির ধারক হচ্ছে বেদ।
- বেদের মধ্য দিয়েই আর্যদের সংস্কৃতি ভারতে ছড়ায় বলে বেদের নামানুসারে এই সভ্যতাকে ‘বৈদিক সভ্যতা’ও বলা হয়।
- আর্য সভ্যতার প্রথম দিকে জীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানার প্রধান সূত্রই হলো বেদ বা বৈদিক সাহিত্য।
- আর্যদের সমাজ-জীবন বা তাদের সম্পর্কে যা-কিছু ধারণা তার প্রায় সবকিছুরই জানার উৎস হলো বৈদিক সাহিত্য ভাণ্ডার। এক্ষেত্রে আর্যদের সম্পর্কে প্রথম ধারণা স্পষ্ট হয় প্রাচীনতম গ্রন্থ ঋগ্বেদ থেকে।
- আর্যদের সমাজ ছিলো মূলত পুরুষতান্ত্রিক অথবা পিতৃতান্ত্রিক।
- আর্যরা গাভীকে পুজা করত।
- সমাজে পুরুষেরই প্রাধান্য ছিলো। পশুপালন, শিকার– এসবে পুরুষের কাজই বেশি ছিলো। চাষ শেখবার পরে মেয়েরা খেত পাহারা দেওয়া, কাপড় বোনা, রান্না, শিশু, বৃদ্ধ ও পুরুষদের সেবায় দিন কাটাতো; হয়তো কিছু সবজি ও ফসলের চাষও করতো।
- ঋগ্বেদের বর্ণনানুযায়ী আর্যাবর্তের অধিবাসীগণের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি ও পশুপালন।
- আর্যগণের প্রধান খাদ্য ছিল ভাত, রুটি, দুধ, ঘি এবং মাংস।
- আর্যদের বিনোদনের বিষয় ছিল নৃত্যগীত।
- সুতাকাটা ও বয়নশিল্প প্রত্যেক আর্যগৃহেই প্রচলিত ছিল, সুতীবস্ত্র ছাড়া চামড়ার পোশাকও ব্যবহৃত হতো।
- বৈদিক ভারতীয়দের প্রাচীনতম লিপিকে বলা হয় ‘ ব্রাহ্মীলিপি ’।
- আর্যরা লিখতে শিখেছে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীর পর।